সিভি লেখার নিয়ম? আসলে জীবনবৃত্তান্ত বা সিভি কথাটির সাথে আমরা পরিচিত হই ছাত্রজীবনেই। কেননা ছাত্র জীবনেই আমাদের বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনে যোগ দিতে বা কোন পার্ট টাইমে চাকরিতে যোগদান করতে সিভি চাওয়া হয়। সেখান থেকেই আসলে সিভি লেখার হাতেখড়ি হয়।
কিন্তু অধিকাংশই আছেন যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে তারপর সিভি তৈরি করেন। অনেকে আবার খুব অল্প সময় হাতে নিয়ে সিভি তৈরি করেন। তাড়াহুড়া করে সিভি লিখতে গিয়ে অনেকেই আবার মারাত্মক ভুল করে ফেলেন। ফলে নিজের প্রথম আবেদন করা চাকরিও হাতছাড়া হয়ে যায়, সামান্য এই ভুলের কারণে।
আরও পড়তে পারেন- নিজেকে এগিয়ে রাখুন ২১ উপায়ে
যার অন্যতম কারণ চাকরিদাতাদের হাতে পর্যাপ্ত সময় থাকে না, আপনার সম্পর্কে সম্পূর্ণভাবে জানার। গড়ে মাত্র ৩০ সেকেন্ড সময় পান তারা। তাই সিভি হবে সংক্ষিপ্ত, সিভির তথ্যগুলোর উপস্থাপন হতে হবে সুস্পষ্ট। কোন ভাবেই অপ্রয়োজনীয় বা অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সিভিতে উল্লেখ করা যাবে না।
এজন্য সিভি লেখা বা তৈরি করে করতে বসার আগে সিভি লেখার নিয়ম নিয়ে অবশ্যই স্পষ্ট ধারণা থাকা দরকার। তা হলো নিজের পরিচয়, অর্জন, যোগ্যতার কথা সংক্ষেপে কীভাবে তুলে ধরব? সিভিতে কী থাকবে, আর কী থাকবে না?
সিভি লেখার নিয়ম
নাম
জীবনবৃত্তান্ত বা সিভির প্রথমেই স্পষ্টভাবে নাম লিখতে হবে। এক্ষেত্রে অবশ্যই ডাক নাম ব্যবহার করা যাবে না। এজন্য আপনার সার্টিফিকেটে ব্যবহার করা নাম। এবং নামের বানান একই রাখতে হবে। অনেকেই ছবিতে ডাক নাম বা ছদ্মনাম ব্যবহার করেন। যা মোটেই উচিত নয়।
যোগাযোগের ঠিকানা
নামের সাথে সংক্ষিপ্তভাবে অবশ্যই যোগাযোগের ঠিকানা উল্লেখ করতে হবে। এক্ষেত্রে অনেকেই ভুল করে থাকেন। আপনি সেই ঠিকানা ব্যবহার করবেন, যেখানে যোগাযোগ করলে সহজেই আপনাকে পাওয়া যাবে। অর্থাৎ আপনি থাকেন ঢাকায় কিন্তু আপনার যোগাযোগের ঠিকানা দিয়েছেন সিরাজগঞ্জ। চাকরিদাতা আপনাকে যথাসময়ে খুঁজে পাচ্ছেন না। ফলে হয়রানীর স্বীকার হন।
সিভির মুঠোফোন নাম্বার
সিভিতে সংক্ষিপ্ত ঠিকানার পাশেই অবশ্যই মুঠোফোন নাম্বার উল্লেখ করতে হবে। এজন্য একাধিক মুঠোফোন নাম্বার ব্যবহার না করাই ভালো। আপনাকে সার্বক্ষণিক যে নাম্বারে পাওয়া যাবে, সেই নাম্বার সিভিতে উল্লেখ করতে হবে। অনেকেই সিভিতে ভিন্ন ভিন্ন নাম্বার ব্যবহার বা দ্রুত নাম্বার পরিবর্তন করে ফেলেন। যা উচিত নয়।
ই-মেইল ঠিকানা ব্যবহার
নামের পাশেই যেখানে যোগাযোগের সংক্ষিপ্ত ঠিকানা ব্যবহার করবেন। সেখানে ই-মেইল এড্রেস বা ঠিকানা ব্যবহার করতে হবে। এই ই-মেইল ঠিকানা অনেকেই নিজের নাম ব্যবহার করেন না, অনেক সময় হাস্যকর বিষয় দিয়ে ই-মেইল এড্রেস খুলে থাকেন। যা আপনার সম্পর্কে চাকরিদাতাকে চরম খারাপ ধারণা দেয়। যেমন ধরুণ, ekabaloksabuj@gmail.com বা shapnobazrahim@gmail.com। এসব নামের ই-মেইল ঠিকানা আপনার সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা দেয়। তাই নিজের নামের সাথে মিল রেখে ই-মেইল ঠিকানা তৈরি করে সিভিতে ব্যবহার করতে হবে। নিজের সিভিতে অন্যের ই-মেইল ঠিকানা ব্যবহার করেন। যা খুবই দৃষ্টিকটু।
অনেকেই ই-মেইলের সাথেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যেমন ফেসবুক, টুইটার লিঙ্ক দেন। যা এড়িয়ে চলাই ভালো। তবে লিংকড–ইন প্রোফাইলের ঠিকানা ব্যবহার করতে পারেন। তবে আপনার ব্যক্তিগত তথ্য রয়েছে এমন ওয়েবসাইটের ঠিকানা ব্যবহার করতে পারেন। যা আপনার এবং আপনার কাজ সম্পর্কে ভালো ধারণা দেয়।
সিভিতে ছবি
সিভিতে ছবি ব্যবহার করতে হবে সাম্প্রতিক সময়ে তোলা! জেনো আপনাকে সহজে চেনা যায়। অনেকেই সিভিতে পুরাতন ছবি ব্যবহার করেন। ছবি উঠানোর সময় ছবির ব্যাকরাউন্ড বা পটভূমি অবশ্যই এক রঙয়ের হতে হবে।
ছবিতে চুল কিংবা দাড়ি পরিপাটি থাকতে হবে। ছবি হতে হবে ফরমাল। ছবির ব্যাকরাউন্ড বা পটভূমি বেশি উজ্জ্বল না হওয়া শ্রেয় । অনেকেই মুঠোফোনে যত্রতত্র ছবি তুলে কোন রকমভাবে সিভিতে যুক্ত করেন। যা মারাত্মক ভুল।
পেশাগত বিবরণ
এ পর্যায়ে সিভিতে সংক্ষিপ্তভাবে নিজের পেশাগত বিবরণ উল্লেখ করতে হবে। এখানে আপনার পূর্ববর্তী স্থানে আপনার অবস্থান এবং কাজ সম্পর্কে তুলে ধরুণ। মনে রাখতে হবে এ অংশ অবশ্যই বড় হওয়া যাবে না। ভাষা হতে হবে প্রাঞ্জল।
বাংলা বা ইংরেজি যে মাধ্যমেই লিখবেন বানান সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। এ ক্ষেত্রে আপনি যে পদে চাকরি করবেন, তার সাথে সঙ্গতি রেখে এ অংশ লিখতে হবে। অবশ্যই আজগুবি, অপ্রাসঙ্গিক কিংবা কাল্পনিক কোন বিষয় সিভিতে লেখা যাবে না।
শিক্ষাগত যোগ্যতা
শিক্ষাগত যোগ্যতা লিখতে গিয়ে অনেকেই গুলিয়ে ফেলেন। কোনটা আগে লিখবেন। সদ্য পাস করা পরীক্ষার সম্পর্কে নাকি একদম মাধ্যমিক থেকে অর্জিত ফলাফল সম্পর্কে। এ বিষয়ে সুস্পষ্ট পরামর্শ হচ্ছে সদ্য পাস করা বিষয় প্রথমেই উল্লেখ করতে হবে। আপনি যদি সম্প্রতি স্নাতক পাস করেন তবে সেই সম্পর্কে আগে লিখুন। যেমন আপনি কোন বিষয়ে, কোন অনুষদে পড়েছেন, কত সালে পরীক্ষা দিয়েছেন, গ্রেড পয়েন্ট বা ফলাফল কী ছিল, এসবও উল্লেখ করতে পারেন।
এভাবে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায় থেকে ধারাবাহিকভাবে উচ্চ মাধ্যমিক ও মাধ্যমিক পরীক্ষা সম্পর্কে লিখতে হবে। আর আপনি যদি কোন বিষয়ে অধ্যয়নরত থাকেন, সে বিষয়ে উল্লেখ করে ‘পরীক্ষার্থী’ বা ‘অধ্যয়নরত’ লিখতে হবে।
অ্যাকাডেমিক প্রকাশনা বা প্রকল্প
আপনার স্নাতক বা স্নাতকোত্তর পর্যায়ের কোন প্রকাশনা বা রিপোর্ট থাকলে তা উল্লেখ করুন। আর আপনি যদি প্রকৌশল অনুষদের শিক্ষার্থী হন তবে কোন প্রজেক্টে অংশ নিলে তা উল্লেখ করবেন। আর বিবিএ বা বিজনেস স্টাডিজ অনুষদের শিক্ষার্থী হয়ে থাকলে আপনার ইন্টার্ন হিসেবে কাজ করলে তার রিপোর্টের নাম লিখুন।
বিশেষ করে যদি কেউ কোনো জাতীয় বা আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশ নেন। তাহলে তার বিষয়ে সংক্ষিপ্ত তথ্য বা সে বিষয়ের বিবরণ সিভিতে যুক্ত করুন। যা আপনার সিভিকে সমৃদ্ধ করবে।
পেশাগত অভিজ্ঞতা
পেশাগত অভিজ্ঞতা লেখার ক্ষেত্রে অবশ্যই আপনি যে পদের জন্য সিভি জমা করবেন। সেই বিষয়কেই বেশি প্রাধান্য দিতে হবে। যারা সদ্য স্নাতক সম্পন্ন করেন তাদের ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা থাকে না বললেই চলে। তারা যদি কোন প্রতিষ্ঠানে খণ্ডকালীন চাকরিতে যুক্ত থাকেন সে বিষয়ে অভিজ্ঞতার বিবরণ সিভিতে লিখতে পারেন। যেমন কোন পদে, কত দিন চাকরি করেছেন।
স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজ
অনেকেই একই বিষয়ে পড়শোনা করলেও কারো হয় এক পৃষ্ঠার সিভি কারো বার দুই পৃষ্ঠা। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় পড়শোনা অবস্থায় অনেকেই কেবল সিজিপিএ বাড়ানো নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। কিন্তু কেউ কেউ আবার পড়াশোনার পাশাপাশি বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনে যুক্ত হন। যা সিভিতে উল্লেখ করা যেতে পারে।
স্বেচ্ছাসেবক সংগঠনের কাজের সম্পর্কে লিখতে হয়- আপনি কোন কোন সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিলেন, তার নাম। কতদিন ধরে কোন সংগঠনে, কোন পদে এবং কতদিন কাজ করেছেন তার সময়কাল লিখুন। একাধিক সংগঠনে কাজ করলে তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ লিখুন।
কর্মশালা ও প্রশিক্ষণের বিবরণ
ছাত্রজীবনে যদি কোন প্রশিক্ষণে অংশ নিয়ে থাকেন, তবে তা উল্লেখ করবেন। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে অনেকেই বিভিন্ন সংগঠনে অংশ নেওয়ায় বিভিন্ন কর্মশালা এবং প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে থাকেন। আপনি যে পদে আবেদন করতে চান, সে পদের সাথে সংশ্লিষ্ট হলে তা সংক্ষিপ্তভাবে সিভিতে তুলে ধরুণ। এর মধ্যে অনলাইনে কোন প্রশিক্ষণ কোর্স সম্পন্ন করলেও সেটাও তুলে ধরতে পারেন।
ভাষাগত এবং কম্পিউটার বিষয়ক দক্ষতা
সাধারণত চাকরিতে বাংলা এবং ইংরেজি ভাষা জানাকে আবশ্যক হিসেবে ধরা হয়। তাই এই বিষয়টি অবশ্যই ভাষাগত দক্ষতায় তুলে ধরতে হবে। আর যদি আপনি আইইএলটিএস বা টোয়েফলে অংশ নেন তার স্কোর তুলে ধরুণ। তাছাড়া বর্তমানে কম্পিউটার বিষয়ক দক্ষতা থাকা খুবই জরুরী। তাই সিভিতে মাইক্রোসফট ওয়ার্ড, এক্সেল ও পাওয়ারপয়েন্ট জানা থাকলে লিখতে হবে। সেইসাথে কম্পিউটার বিষয়ে কোন বিশেষ জ্ঞান থাকলে তা উল্লেখ করতে হবে।
নিজের শখ ও আগ্রহ
সিভিতে সংক্ষেপে আপনার দুই-একটি আগ্রহ ও শখের কথা লিখতে পারেন। এতে চাকরিদাতা আপনার শখ ও আগ্রহ সম্পর্কে একটা ধারণা পাবেন।
রেফারেন্স(Reference)
সিভিতে রেফারেন্স অবশ্যই যুক্ত করতে হবে। আপনি যদি বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া হন, সেক্ষেত্রে আপনার শিক্ষকদের নাম, পদবী এবং প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করতে হবে। তবে অবশ্যই যাদের নাম দিবেন তাকে বিষয়টি জানিয়ে রাখুন। আর আপনার যদি চাকরি করার অভিজ্ঞতা থাকে, তবে সেখানে যার অধীনে কাজ করেছেন তার নাম। অথবা কোন পেশাজীবীর নাম সিভিতে যুক্ত করতে হবে।
অঙ্গীকারনামা
সিভিতে সর্বশেষে লিখতে হয় অঙ্গীকারনামা। সিভিতে আপনি যা যুক্ত করেছেন আপনার সব তথ্য সঠিক ও নির্ভুল তা লিখতে হবে অঙ্গীকারনামায়। আর লেখার নিচে আপনার স্পষ্ট স্বাক্ষর থাকতে হবে। মনে রাখবেন, চাকরিদাতা আপনার তথ্য যাচাই করার আইনগত অধিকার রাখেন, তাই এমন কোন তথ্য দিবেন যা আপনার সাক্ষাৎকারের সময় ভুল প্রমাণিত হয়।
সিভি লেখার কৌশল
- সিভিতে কোন রঙিন কাগজ বা রঙিন কালি ব্যবহার করবেন না। কোন বিষয়ে হাইলাইট করতে চাইলে লেখাটি বোল্ড, ইটালিক বা আন্ডারলাইন করতে পারেন।
- সিভি আকর্ষণীয় হওয়া জরুরী। তাই বলে অবান্তর চটকদার বিষয় এড়িয়ে চলুন।
- সিভি লিখবেন এ ফোর সাইজের পাতায়। পাতাটি সাদা হওয়াই শ্রেয়।
- অন্যের সিভি হুবহু কপি করতে যাবেন না, এতে আপনার অজান্তেই ভুলত্রুটি রয়ে যাবে। যা চাকরিদাতাদের চোখে প্রথমেই পড়বে।
- নমুনা সিভি দেখে নিজের প্রথম সিভি নিজেই লিখুন। পরে তাতে সময়ে সময়ে তথ্য যোগ করুন।
- সিভি অহেতুক বড় করার চেষ্টা করবেন না। বড় সিভি মানেই ভালো সিভি নয়। চাকরিদাতারা গড়ে মাত্র ৩০ সেকেন্ড সময় পাবেন সিভি দেখার। তাই সিভি হবে সংক্ষিপ্ত ও অর্থবহ।
- সিভিতে বানান ভুল আপনার মারাত্মক শত্রু। এটা আপনার সম্পর্কে চাকরিদাতাকে নেতিবাচক ইঙ্গিত দেয়।
- অভিজ্ঞদের দিয়ে সিভি চেক করিয়ে নিন। অনেক সময় নিজের ভুলে নিজের কাছে ধরা পরে না। তাই আপনার শিক্ষক বা অভিজ্ঞ সিনিয়রদের সাহায্য নিন।
- সিভি তৈরি করতে হবে চাকরির ধরণের সাথে। অর্থাৎ আপনি যে পদ বা প্রতিষ্ঠানের জন্য সিভি জমা বা মেইল করবেন, সেই পদের দিকে খেয়াল রেখে সিভি তৈরি করুন। প্রয়োজনে সেই প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে আগে ভালো করে জানুন।
- সিভিতে কাভার লেটার যুক্ত করুন।
- ভুল বা অতিরঞ্জিত তথ্য দিবেন না।
- অপরিচিত বা কম পরিচিত মানুষকে রেফারেন্স হিসেবে উল্লেখ করবেন না।
- আপনার সম্পর্কে ভালো জানেন এমন কোন ব্যক্তিকে রেফারেন্স দিন।
আরও দেখতে পারেনঃ স্কিল ডেভেলপমেন্টের ৭ পরামর্শ
লেখাটি খুবই ভালো লাগলো।আশা করি ভবিষ্যতে আপনার থেকে আরো ভালো লেখা পাবো এই সাইট থেকে।